
নয়াদিল্লি: পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী তালিকার সংশোধন কাজ এমাসেই শুরু হতে পারে বলে রাজ্যের আধিকারিকদের জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের আয়োজিত ভার্চুয়াল সভায় অংশগ্রহণকারী দু-জন রাজ্য আধিকারিক স্বতন্ত্রভাবে দ্য রিপোর্টার্স কালেক্টিভকে জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ নিবিড় সংশোধনের নির্দেশ আগামী দু-সপ্তাহের মধ্যেই আসতে পারে। বলাই বাহুল্য, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্যপ্রদানের অনুমোদন নেই— এই মর্মে তাঁরা নামপ্রকাশ থেকে বিরত থেকেছেন।
"ভার্চুয়াল সভায় আমাদের এর জন্য প্রস্তুতি শুরু করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে লিখিত নির্দেশ শীঘ্রই আসবে," বলছেন ওই দুই আধিকারিকের একজন।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ভোটার তালিকার স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া বিহারে শুরু হয়েছে ২৪ জুন। এই সংশোধন প্রক্রিয়ায় একদম গোড়া থেকে ভোটারদের তথ্য যাচাই করা হবে। বিহারে, ইসিআই সমাজের আলাদা আলাদা শ্রেণিভুক্ত ভোটারদের জন্য আলাদা আলাদা নথিপত্রের যাচাই বাধ্যতামূলক করেছে—এ ঘটনা ভারতের নির্বাচনী রাজনৈতিক ইতিহাসে এর আগে কখনও ঘটেনি। কমিশনের তরফে এই কাজের জন্যে মাত্র তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, জোর দিয়ে বলা হয়েছে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের নাগরিকত্বও যাচাই করতে হবে। নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার প্রমাণের জন্য বৈধ বলে বিবেচিত নথির সংখ্যা সীমিত করা হয়েছে।
"পশ্চিমবঙ্গে বিহারের মতোই, নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের নথিপত্রের প্রমাণ চাইবে কিনা এখনও জানি না। কিন্তু এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে, সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করবে," দ্য কালেক্টিভকে বলেন দ্বিতীয় আধিকারিক।
তাঁর কথায়, "এই কাজের জন্যে আমরা হয়তো বিহারের চেয়ে একটু বেশি সময় পাব। কারণ অক্টোবর আমাদের পুজোর মাস।"
তবে বিহারের মতোই পশ্চিমবঙ্গও বেকায়দায় পড়তে পারে। এ রাজ্যে সাম্প্রতিক অতীতে নির্বাচনী তালিকার পূর্ণাঙ্গ সংশোধন হয়েছে। এখন কমিশনের নির্দেশ এলে সেই সংশোধিত তালিকা বাতিল করে আবার নতুন করে তৈরি করতে হবে। এই কর্মযজ্ঞ এমন সময় সম্পন্ন হবে যখন নির্বাচন দোড়গোড়ায়।
উল্লেখ্য, ২০২৬ সালের মে মাসের আগেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন।
"যদিও আমাদের কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা জানানো হয়নি, তবে কথাবার্তা শুনে যা মনে হচ্ছে, আমরা এই কাজের জন্যে খুবই কম সময় পাব। আইন অনুযায়ী, নিবিড় সংশোধন মানে একদম নতুনভাবে ভোটাদের নাম নথিভুক্তকরণ প্রক্রিয়া", বলছেন সংশ্লিষ্ট রাজ্য-প্রতিনিধি।
ভোটার তালিকা সংশোধনের ক্ষেত্রে নির্বাচন বিহারের পরেই বাংলাকে বেছে নিতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র সুপ্রিম কোর্টে এই অভূতপূর্ব বিশেষ নিবিড় সংশোধনের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে মামলা দায়ের করেন। বিহারে সশোধন প্রক্রিয়া শুরু হতেই পিটিশান দাখিল করেন আরজেডি সাংসদ মনোজ ঝা-ও।
পাশাপাশি, জাতীয় কংগ্রেস-সহ ইন্ডিয়া জোটের অন্যান্য বিরোধী দলগুলিও নির্বাচন কমিশনের এই হঠাৎ নির্বাচনী তালিকা সংশোধনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন দায়ের করেছে। রাজনৈতিক দলগুলি ছাড়াও, নির্বাচন পর্যবেক্ষক নাগরিক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রাইটসও এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে শীর্ষ আদালতে আবেদন করে। আজ, ১০ জুলাই সকলের মামলা শুনবে সুপ্রিম কোর্ট।
কেন বিতর্ক?
নির্বাচন কমিশন যে বিশেষ নিবিড় সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছে, তা কমিশনের নির্দেশিকায় বা ম্যানুয়ালে নেই।
প্রতি বছর রাজ্যে রাজ্যে মৃত্যু, স্থানান্তর, নগরায়ণ বা নতুন ভোটারদের হিসাব রাখার জন্য ভোটার তালিকা সংশোধনের যে প্রক্রিয়া চলে, এই প্রক্রিয়া তার বিপ্রতীপে একদম পূর্ণাঙ্গ সংস্কার। নির্বাচন কর্তৃপক্ষ ভোটার তালিকা নতুন করে তৈরি করে এই প্রক্রিয়ায়। কমিশন দাবি করছে, নির্বাচনী তালিকায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কারণে এই বিশেষ ধরনের সংশোধন আশু প্রয়োজ ন।
দ্য কালেক্টিভের পূর্ববর্তী প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিহারের ক্ষেত্রে কমিশনের এই যুক্তি একেবারেই সঠিক নয়। প্রতিবেদনটি এখানে (ইংরেজিতে) পড়া যাবে।
গত বছরের বিহারে তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়া নিষ্পন্ন হওয়ার পর তাতে উদ্বেগজনক কোনো অসঙ্গতি ধরা পড়েনি। ওই নির্বাচনী তালিকার স্বচ্ছতার সূচক যেমন জনসংখ্যার সঙ্গে ভোটারের অনুপাত, ২০২৪, ২০২৩, ২০২২ এবং ২০২১ সালের চূড়ান্ত তালিকার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণই ছিল।
বিহারের মতো, পশ্চিমবঙ্গও নিয়মিত নির্বাচনী তালিকা সংশোধন করে আসছে। গত বছর এ রাজ্যে বিশেষ সংক্ষিপ্ত সংশোধন সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে চূড়ান্ত নির্বাচনী তালিকা। বুথ-স্তরের আধিকারিকরাও নিশ্চিত করেছেন যে তারা এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন।
বিহারের খসড়া এবং চূড়ান্ত নির্বাচনী তালিকা উভয়ই নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ২০২৫ সালের জানুয়ারির চূড়ান্ত তালিকা রাজ্য বা কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইটে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের কার্যালয়কে বুথ-স্তরের নাম সংযুক্তি ও বিয়োজনের তালিকা প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যে তালিকায় নির্বাচকরা নিয়মিত আপডেট করেন। এগুলোও সর্বজনীনভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
তবে, দ্য কালেক্টিভ পশ্চিমবঙ্গের কিছু নির্বাচিত জেলার ভোটার তালিকা পর্যালোচনা করেছে। সেসব নথি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত, ২০২৫ সালের জানুয়ারির তালিকাকে ইসিআই নিয়মিত আপডেটের জন্য বৈধ ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে।

"আমরা তো নির্ধারিত সময়সূচি মেনেই কাজ শেষ করেছি। এখন যদি কমিশন বিশেষ নিবিড় সংশোধনের নির্দেশ দেয় তাহলে বুঝতে হবে ২০২৫-এর তালিকা ত্রুটিপূর্ণ ধরে নিয়ে বাতিল করা হচ্ছে," বলছেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিক।
"কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে কয়েক দশক ধরে ধারাবাহিক ভাবে বার্ষিক পর্যালোচনা প্রক্রিয়ায় বিচ্যুতি ঘটেছে। তাই একটি নিবিড় সংশোধন করা প্রয়োজন। নিবিড় সংশোধন মানে প্রতিটি ভোটারকে নতুন করে নথিভুক্ত করা। কিন্তু, বিহারে যেভাবে এই কাজ করা হচ্ছে, তা মোটেও সমীচিন নয়। কেবলমাত্র কয়েক দশক পুরনো ভোটার তালিকায় থাকার কারণে একদল ভোটারকে বৈধ বলে গণ্য করা এবং বাকিদের নির্দিষ্ট নথিপত্রের ভিত্তিতে নতুন করে পরিচয় ও নাগরিকত্ব নপ্রমাণ করতে বলা যায় না," মন্তব্য দ্বিতীয় আধিকারিকের।
এই প্রতিবেদনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের কাছে প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল। মূল প্রতিবেদন এবং তার অনুবাদ প্রকাশের সময় পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। উত্তর পেলে প্রতিবেদনটি আপডেট করা হবে।
